Budget Predictions 2017

জোর ধাক্কা আসছে, সতর্ক হতে হবে বাজেট প্রস্তাবে

রূপেন রায় সোমবার, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ ০৬:৫৮

AddThis Sharing

05.4K

SHARES

এ বারের বাজেট নানা দিক থেকেই নজরকাড়া। এ বারে এত কিছু ঘটেছে ও ঘটে চলেছে যে তার কোনও প্রতিফলন বাজেটে পড়বে কি না সে দিকে সকলেরই নজর রয়েছে।

কী দিশা দেখাবেন জেটলি?

0 Comments

এ বারের বাজেট নানা দিক থেকেই নজরকাড়া। এ বারে এত কিছু ঘটেছে ও ঘটে চলেছে যে তার কোনও প্রতিফলন বাজেটে পড়বে কি না সে দিকে সকলেরই নজর রয়েছে।

মনে হয়, এ বারে কর্পোরেট কর কমতে পারে। এখন সারচার্জ ধরে মোটামুটি ভাবে ৩৪.৬১ শতাংশ কর্পোরেট কর ধরা হয়। বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতার কথা মাথায় রেখে তা কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হতে পারে।এর একটা কারণও আছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক এর অন্যতম কারণ। ট্রাম্প আগেই বলেছেন, তিনি কর্পোরেট কর কমিয়ে ১৫ শতাংশ করবেন। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ টাকাটাই আসে ফরেন ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টর (এফআইআই) থেকে। যদি দেখা যায় আমেরিকা এই কর কমিয়ে দিল, তা হলে ভারতকেও তা কমাতে হবে।

বস্তুত, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির উপর চাপ আরও বাড়বে। কর্পোরেট কর কমালে বিরোধীরা বলবে, এই সরকার স্যুট-বুটের সরকার।

তবে, জেটলিরও অন্য হাতিয়ার আছে।

বিমুদ্রাকরণের পর ব্যাঙ্কগুলোতে প্রচুর টাকা জমা পড়েছে। এর একটা বড় অসুবিধা হল যে ব্যাঙ্কগুলো এত টাকা ঋণ হিসাবে দিতে পারছে না। জমা টাকার উপর সরকারকে সুদও দিতে হচ্ছে। সরকার কৃষি ঋণে বা যাঁরা নতুন বাড়ি কিনছেন তাঁদের গৃহঋণের উপরে সুদ কমিয়ে দিলে নানা দিক থেকে সুফল মিলতে পারে। কৃষকরাও বেশ কিছুটা রেহাই পাবেন, পাশাপাশি রিয়েল এস্টেটও কিছুটা চাঙ্গা হবে। গৃহঋণে সুদের হার কমলে মধ্যবিত্ত সমাজও খুশি হবে।

বিমুদ্রাকরণের সঙ্গে বাজেটের প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও পরোক্ষ যোগ তো আছেই। অনেকে বলছেন, এই যে এত বাড়তি টাকা জমা পড়ল তাতে কালো টাকা সাদা হয়ে গেল। আমার কিন্তু তা মনে হয় না। বরং সরকারি কর্মীরা যদি সৎ ভাবে কাজ করেন, ওই টাকার উৎস খুঁজে বার করেন তা হলে সরকারের ঘরে কর ও জরিমানা বাবদ প্রচুর টাকা জমা পড়বে। আর এই টাকা যদি পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতে খরচ করা হয় তা হলে বহু কর্মসংস্থান হবে, সার্বিক উন্নতিও হবে যথেষ্ট। বাজেটে এ সম্পর্কেও দিশা থাকা প্রয়োজন।

এ বারের বাজেটের আগে আরও একটা অশনিসঙ্কেত দেখা যাচ্ছে। বিষয়টা হল, তথ্যপ্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আয়ের পরিমাণ জিডিপি-র সাত শতাংশ। ডোনাল্ড ট্রাম্প এক দিকে যেমন রক্ষণশীল ভূমিকা নিচ্ছেন তেমনই চিন আবার ভুবনায়নের হোতা। ট্রাম্পের নীতি যদি সত্যিই বাস্তবে রূপায়িত হয় তা হলে ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র জোর ধাক্কা খাবে।

আমেরিকা ও চিনের সাম্প্রতিক নীতি দেখেশুনে কাজি নজরুল ইসলামের কয়েকটি লাইন মনে পড়ে গেল, ‘উল্টে গেল বিধির বিধি/আচার বিচার ধর্মজাতি/মেয়েরা সব লড়ুই করে/মদ্দ করে চড়ুইভাতি।’

এর থেকে রেহাই পেতে কূটনৈতিক পদক্ষেপ করতেই হবে ভারতকে। জোর ধাক্কা অবশ্য দু’দিক থেকেই আসতে পারে। প্রথমত, ট্রাম্পের নীতি। দ্বিতীয়ত, এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও রোবটের বিপুল ব্যবহার শুরু হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এর ফলে বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজ হারাতে চলেছে। তারা গান গাইবে, কবিতা লিখবে, ছবি আঁকবে বা অন্যান্য কাজ করবে। কিন্তু তাদের আগের কাজে আর ফিরতে পারবে না।

এর ফলে সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশ খুব বড়লোক হবে এবং মধ্যবিত্ত সমাজ একেবারে ফাঁপা হয়ে যাবে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হলোউইং অফ মিডল ক্লাস’। ফলে পূর্ণাঙ্গ ভাবে গবেষণা ও উদ্ভাবনের (আরঅ্যান্ডডি) পথে হাঁটতে হবে। বাজেটে এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো উচিত। এবং দেখতে হবে, এই খাতে বিনিয়োগ করলে যেন যথেষ্ট কর ছাড়ের সুযোগ মেলে।

নিতি আয়োগের মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক (সিইও) অমিতাভ কান্ত সুইজারল্যান্ডের দাভোস-এ যে আলোচনায় অংশ নেন সেখানে ভিন্ন একটি বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কানাডার অন্টারিও প্রদেশ এবং ডেনমার্ক ছাড়া এই গবেষণায় সব থেকে এগিয়ে ফিনল্যান্ড। বিষয়টা হল, ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (ইউবিআই)।

এই গবেষণা বলছে, ব্যাপারটা অনেকটা রিভার্স ইনকাম ট্যাক্স-এর মতো। ধরা যাক, সরকার মনে করছে, মোটামুটি জীবনযাপন করতে গেলে কারও আয় হওয়া দরকার বছরে এক লক্ষ টাকা। দেখা গেল বছর শেষে ওই ব্যক্তির আয় হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে বাকি ৭০ হাজার টাকা সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দিয়ে দেবে।

এই ইউবিআই-এর ব্যাপারটা হয়তো এই বাজেটে হবে না। কিন্তু এটা নিয়ে বাজেটে ছোট করে হলেও আলোচনা হতে পারে। যদি হয় তা হলে তা মধ্যবিত্তের কাছে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে।

কয়েক দিন আগে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছিলেন, কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে ব্যক্তিগত আয়কর ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত। আমেরিকার রাজনীতিক রন পল-ও বলছেন, আয়কর তুলে দিয়ে অন্য ভাবে রাজস্ব আদায় করা হোক। এই কয়েক সপ্তাহ আগেই দিল্লিতে গুজব রটেছিল, আয়কর উঠে যাচ্ছে। যদিও সেটা হয়নি। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হল, আয়কর তুলে দেওয়াটা ভাল নয়। সামাজিক সমতা আনতে চাইলে, বৈষম্য দূর করতে চাইলে আয়কর তুলে দেওয়া ঠিক হবে না।

কারণ, ‘ইনডিরেক্ট ট্যাক্স’ বা পরোক্ষ করের অর্থই হল দুই ব্যক্তির মধ্যে আয়ে যত বৈষম্যই থাক না কেন, দু’জনকেই একই হারে কর দিতে হবে। অর্থাৎ, একটা দেশলাই বাক্স কিনতে গেলে মুকেশ অম্বানিকে যে কর দিতে হবে, আমাকে-আপনাকেও সেই কর দিতে হবে। সমান কর, অথচ অসমান আয়। এটা ভারতীয় সমাজের পক্ষে ভাল নয়। দেখা যাক, এ বারের বাজেটে এই বিষয়টি নিয়ে কোনও প্রস্তাব আসে কি না।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ‘লেস ক্যাশ সোসাইটি’ করতে গেলে কার্ডের ব্যবহার অনেক বাড়াতে হয়। কিন্তু আমরা যে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করি তাতে চার্জ দিতে হয়। হয় তা ক্রেতা দেন অথবা বিক্রেতা। এটা চলতে থাকলে ‘লেস ক্যাশ’-এর পথে হাঁটা মুশকিল। এই চার্জটা বইতে হবে সরকারকেই, সুইডেনে যেমন হয়। সুইডেনে ‘জিরো কস্ট ডেবিট কার্ড’ দেয় সরকার। ফলে ওখানে নগদের কারবার একেবারে কম। আমার মনে হয়, একটা নির্দিষ্ট আয়ের সীমার নীচে সবার জন্য এই ‘জিরো কস্ট ডেবিট কার্ড’ দেওয়া দরকার। তা হলে সরকার যেমন চাইছে, সে পথে আরও বেশ কিছু দূর এগোনো যাবে। বাজেটে এ ব্যাপারেও প্রস্তাব এলে ভাল হয়।

(লেখক উপদেষ্টা সংস্থা সুমন্ত্রণা-র সিইও)